Skip to main content

ঢোল-তাশা

যারা পুনে, মুম্বাইতে থেকেছেন তারা নিশ্চই দেখেছেন গণেশ চতুর্থীর (পুজো ) সময় বিশাল বিশাল ঢোল আর কাঁসর রাস্তা জুড়ে বাজচ্ছে। মারাঠি ভাষায় সেটা হলো 'ঢোল-তাশা' সেপ্টেম্বরে গণেশ পুজোর কয়েক সপ্তাহ আগে পুনের নানা স্কুলের মাঠে ড্রিম-ড্রিম করে চরম হারে ঢোল বাজানোর সাথে ঢং-ওঙ-ওঙ তালে, তাল মিলিয়ে কাঁসরের আওয়াজ করে প্র্যাক্টিস চলে বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। বিভিন্ন স্কুলের বড়ো ক্লাসের বাচ্চারা ওই বিরাটাকার ঢোল আর তাশা (আমাদের কাঁসর ) বাজিয়ে পুজোর ঠিক পরের কিছুদিন ধরে পুনের মোটামুটি সব বড়ো রাস্তা জুড়ে ইউনিফর্ম পরে ঢোল-তাশা বাজিয়ে মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রা (চলতি কথায় প্রসেশন) চলে   নানা গ্রুপ রয়েছে যারা ওই অনুষ্ঠান করেন তাদের বলে 'ঢোল-তাশা পাঠক '

বেশ ইন্টারেষ্টিং গল্প আছে এই 'ঢোল-তাশা পাঠকদল গুলোর। যখন পুনাতে ছিলাম একবার সময় করে কিছু তথ্য জোগাড় করেছিলাম। প্রথম দল মানে পাঠক যিনি গণেশ মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রার সময় এই ঢোল-তাশা অনুষ্ঠান পারফর্ম করার ঐতিহ্য শুরু করেছিলেন তাঁর নাম ডঃ বিনায়ক বিশ্বনাথ পেন্ডসে ওরফে আপ্পাসাহেব পেন্ডসে। সংক্ষেপে তার কথা একটু বলি : আপ্পাসাহেব পেন্ডসে ছিলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শী শিক্ষাবিদ, নেতা, সামাজিক সংগঠক, একজন সক্রিয় মতাদর্শী, স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের মতাদর্শে চলতেন এবং স্বামীজির মতোই তাঁর বিশ্বাস ছিল 'শিক্ষার মাধ্যমে জাতির চেহারার পরিবর্তন করার' মাতৃভূমির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। ১৯৪৭- এদেশ স্বাধীন হবার পরপরই তিনি স্বাধীন ভারত পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভারতের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে, অনুপ্রাণিত ইন্টেলেক্চুয়ালদের (বুদ্ধিজীবী ) প্রয়োজন যারা সমাজকে জাগ্রত করতে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে তাদের বুদ্ধি-সত্তা প্রয়োগ করবেন। এইভাবে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য বুদ্ধিমত্তাকে লালন করার উদ্দেশ্যে, তিনি ১৯৬২ সালে 'জ্ঞান প্রবোধিনী প্রশালা' যার অর্থ 'প্রকৃত জ্ঞানের জাগরণকারী' নামে এক স্কুল তৈরি করেন তার সম্পর্কে আরো জানতে হলে গুগলে দেখে নিন প্লিজ। জ্ঞান প্রবোধিনীর আকাশ চৌকাসের সাথে কথা বলে কিছুটা জেনেছিলাম ঢোল-তাশা নিয়ে।


আপ্পাসাহেব পেন্ডসে একজন সৃজনশীল, শৈল্পিক ব্যক্তিও ছিলেন। গান ছিল তাঁর বড় প্রিয় জিনিস, বিশেষ করে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। তা নিয়ে তাঁর ভালো রকমের জ্ঞানও ছিল। তিনি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে খুব বিশ্বাস করতেন আর শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করতে উৎসাহ দিতেন। গান অন্যান সাংস্কৃতিক কাজগুলোর জন্য বাচ্চাদের আগ্রহ বাড়াতে তিনি ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রবোধ স্কুল, বালক পাঠক নামে শুরু করেন।


সেই স্কুলে আপ্পাসাহেব প্রথম 'বার্চি নৃত্য' চালু করেন। বার্চি নৃত্য/নাচ সম্পর্কেও একটু বলি, না হলে ঠিক জমবে না ব্যাপারটা। বার্চির নাচের এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সময় এই নাচ যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত, ভাবা যাচ্ছে ! স্বয়ং শিবাজী মহারাজ এই বার্চি নৃত্য করতেন | যুদ্ধের সময়, শত্রু পক্ষ দিশেহারা হয়ে যেত কি হচ্ছে এই ভেবে। অনেকে মনের আনন্দে নাচ দেখতো সেটাই তাদের কাল হতো, যুদ্ধের ধরণ ছিল বার্চি নৃত্য। বার্চি নাচ মূলত একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়মাফিক খুব উদ্যমী দলগত নৃত্য শিল্প। এক মানানসয়ী তাণ্ডব জাতীয় ছন্দের প্রয়োজন আর তাই তিনি সেই তালের জন্য ঢোল-তাশা যোগ করেছেন এই নাচে আপ্পাসাহেবই প্রথম তার তৈরি পাঠকে জাফরান (গেরুয়া ) পতাকা ব্যবহার করেন। তখন মিছিলে, বিভিন্ন জমায়েতে পাগলের মতো পতাকা নাচানো হত না।


তবে বাকি সব কাজের মতোই সহজেই এই ঢোল-তাশার আওয়াজ এখনকার এই উত্তেজনা, পরিচিতি পায়নি। আপ্পাসাহেবকে অনেক কাঠ খড় পড়াতে হয়েছে আজকের এই পপুলার 'ঢোল-তাশা' নামটার জন্য। সেই সময় পুনেতে কিন্তু একেবারেই ঢোল-তাশা সহজে পাওয়া যেত না আপ্পাসাহেব তাঁর  দলবল নিয়ে পুনের কাছাকাছি গ্রামে যেতেন এবং কাঠের তৈরি ঢোলের ব্যবস্থা করতেন। সব শেষে প্রায় সাত রকমের ঢোল বাজানোর তাল আর মোটামুটি এগারোটি বার্চি নৃত্যের ফর্ম তৈরি হয়েছিল ওই প্রচেষ্টায়। 


এবারে সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ কথায় আসি : যুদ্ধের সময় বার্চি নাচ করা হতো বলে এই 'বার্চি-ঢোল-তাশা' এক সাথে বাজানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি, মনোবল, উদ্যম শৃঙ্খলা আর প্রচুর-প্রচুর অনুশীলনের দরকার।






জ্ঞান প্রবোধিনীর পাঠক গঠনের পর আপ্পাসাহেব কিন্তু থেমে থাকেননি, তিনি তার দল নিয়ে অন্যান স্কুল যেমন, বিমলাবাই গড়ওয়ার প্রশালা, নুমাভি প্রশালা, রমনবাগ প্রশালায় যান এবং তাঁদের স্কুলেও 'বার্চি-ঢোল-তাশা' পাঠক শুরু করতে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে উপরের সবকটা স্কুলই নিজস্ব বার্চি পাঠক তৈরি করেছে সময়ের সাথে সাথে আপ্পাসাহেব মেয়েদেরও এই 'বার্চি-ঢোল-তাশা' পাঠক দলে যুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালে আপ্পাসাহেবর জ্ঞান প্রবোধিনী প্রথম বালিকা পাঠকের দল তৈরি করে। যে ভিডিও গুলো শেয়ার করেছি তাতে মেয়েরাই ঢোল-তাশা বাজাচ্ছে আর তালে তালে বার্চি নাচ নাচছে। ওই ভারী ঢোল গলায় ঝুলিয়ে ওই সেমি-তাণ্ডব নৃত্য করা চারটি খানি কথা নয়  ! অনেক ঘাম-রক্ত ঝরলে গিয়ে সেই পারফেকশন আসে।


তবে বিবর্তনের সাথে সাথে সেই সুশৃঙ্খল গত ভাবে বার্চি নাচের ভঙ্গিমা, দৃষ্টিভঙ্গি বেশ খানিকটা পরিবর্তন হচ্ছে, জনপ্রিয়তা পাবার লক্ষ্যে। জানিনা কতদূর কি হবে। এই সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্য আর তার উদ্দামনা কোথায় ঠেকবে, আদৌ বার্চি নাচের সেই ফর্ম থাকবে নাকি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে!


তবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ইতিবাচক শক্তি, ন্যায়, পরিশ্রম, শিল্পের যত্ন ঐক্যের শক্তির দ্বারা এখনো হচ্ছে। একই সম্মিলিত প্রচেষ্টা সামাজিক পরিবর্তনের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শ্রী আকাশ চৌকাসে, জ্ঞান প্রবোধিনী। আপনি যদি জ্ঞান প্রবোধিনী সম্পর্কে আরও জানতে চান তাহলে www.jnanaprabodhini.org ক্লিক করুন।


একটা ছোট্ট নোট: আগে গণেশ চতুর্থী এক ব্যক্তিগত নিতান্ত ঘরোয়া উৎসব হিসাবে পালিত হত, আমাদের লক্ষী পুজোর মতো সাল ১৮৯৩- লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক পুনে থেকে প্রথম সর্বজনীন অনুষ্ঠান হিসাবে উদযাপনের ঐতিহ্য শুরু করেন।

Comments

Popular posts from this blog

কদম ফুল - Kadam phool- common burflower

বর্ষাকালের সিগনেচার বলা হয় কদম ফুলকে , আরেক নাম নীপ , " এসো নীপ বনে ... " কবিতা তো জানাই আছে যাতে বর্ষা মানেই নীপ ( কদম্ব ও বলে অনেক রাজ্যে ) ।   খুব পরিচিত এই ফুল , নিটোল গোলাকার , প্রথমে সবুজ , পরে লাল থেকে টকটকে কমলা রঙের সাথে অসংখ্য লম্বা সাদা ফ্রিলস পুরো ফুল জুড়ে ।   হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ একটু ভারী , মানে কাউকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আর ওই সাদা ফ্রিলস গুলো এমনিতে নরম কিন্তু ছুড়লে হুঁহুঁ , লাগবে বেশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে , গাছের পাস দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় ফুল ফুটেছে   ( কদম তলায় কে ?) । প্রচুর ফ্র্যাংগনান্স বা আতর তৈরি হয় এই গন্ধের। আমাদের দেশের লিপিগুলোতে কদম ফুলের ও গাছের নাম আছে আর আমাদের পৌরাণিক কথকথায় কদম ফুলের বড়ো মুখ্য একটা জায়গা আছে।   ভারতের উত্তর দিকে , ভগবৎ পুরান থেকে শুরু রাধা ও কৃষ্ণের দুজনের জীবনেই   কদম ফুল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।   বৃন্দাবন - মথুরায় , গোবর্দ্ধন পাহাড়ের দিকে   প্রচুর কদম গাছ , এই সময় মানে বর্ষাক...

My days in the Gunj 2

Since couple of months planning to go in the Gunj but due to some other directions wasn't able to reach there. Finally at the end of year 2023 reached there, stayed in the colonial hut and explored the place on my motorcycle. The Gunj means the McCluskieganj, during mid nineties this hamlet was known as Mini England as it was the place for Anglo-Indians. But now only few family of Anglo-Indians are living here. Yeah, here is scope to stay in the colonial tiles hut as few of the homes are still maintaining the traditional home. I reached on 22nd of December, and had an advanced booking as this time become so crowded due to the holiday and festive season. While I was looking for my stay in Gunj as I used to do getting the contacts from google and calling them. Most of the homestay were not vacant on the dates which I decided to be there, but from the owner of Amyra homestay got a contact of Manojay the care taker Mac Garden and for 2 days he has a room. Here is a story, Mr. Raj Kisho...

My days in the Gunj

এখানে সকাল হয় না, সকাল আসে... কার লেখা, কোন উপন্যাস, অনেকেই জানেন।  গল্পটা এরকম... ডিসেম্বরে হুট্ করে বাইক নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু থাকার জায়গা পেতে চাপ হয়। যেমন এবার হোলো ! ম্যাপ খুঁজে খুঁজে হোমস্টে দেখছি আর ফোন করে যাচ্ছি, ' নাহঃ, ওই সময় ফাঁকা নেই', বেশ কয়েক জায়গা থেকে এক উত্তর পেয়ে ভাবছি কি করবো ! তখনই আমায়রা হোমস্টে-র ওনার রাজ কিশোর গুপ্তা রিং ব্যাক করে 'ম্যাক গার্ডেন-র' হোমস্টে-র কেয়ার টেকার মনজয় দার ফোন নম্বর দিলেন। কল করে জানালাম, পরের দিন যাচ্ছি, একটা ঘরই আমার লাগবে। দু-তিন থাকবো বলাতে বললো, দুদিনই হবে তিন নম্বর দিন অলরেডি বুকড। সাত একর জমির এক কোণে এক কোলোনিয়াল বিল্ডিং, মানে টালির ছাদের কুঁড়েঘর। আম বাগানে ঘেরা, বিরাট এক লন সামনে। গেটের ডানদিকে আলু, সর্ষের খেত। টিয়া, ধূসর রঙের ধনেশ চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। বাড়ির ভেতরে তিনটে পার্টিশন, প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকেই বসার জায়গা আর দুই প্রান্তে দুটো ঘর। ওই জায়গা পেরিয়ে পেড়িয়ে আবার আর একটা দরজা ও দুই প্রান্তে ডান দিকে-বাঁদিকে দুটো ঘর। মাঝের বসার জায়গায় একটা ফায়ারপ্লেস। শীতকালে গেলে দিব্বি জ্বালিয়ে রাত কাটানো য...