কলকাতার পুরানো, বড়ো বাড়ি গুলো যেগুলো 'হেরিটেজ বিল্ডিং'-র তকমা পেয়েছে সেগুলো নিয়ে তথ্য ও ছবি জোগাড় করে লেখা শুরু করেছি।
এর আগে কুইন্স ম্যানসন নিয়ে লিখেছিলাম, লিংক - https://www.theroamingdiary.com/2021/09/blog-post_24.html
এসপ্ল্যানেডে সিঁধু কানু ডহর (রাস্তা ) ধরে রাজ ভবনের দিকে এগোলে ডান দিকে একটা অপূর্ব সাদা, পাঁচতলা সুন্দর বাড়ি রয়েছে, ওপরে LIC লেখা | বাড়িটার নাম “এসপ্ল্যানেড ম্যানশন “, বাড়ির সামনে একতলাতেই লেখা ইংরাজিতে নামটা | বাড়িটার ডিসাইন বা আর্কিটেকচার যত বার দেখেছি মুগ্ধ হয়েছি। ধবধবে সাদা (আগে রং ছিল হাল্কা গোলাপি) আর্ট নুভেউ স্টাইলে বানানো। রাস্তার এক কোনা থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে দুপাশে ঘর বেড়েছে, জবা ফুল জাতীয় কোনো ফুলকে মাঝ বরাবর কাটলে যেমন দেখতে হবে বাড়ির গঠন অনেকটা সেরকম। এই এসপ্ল্যানেড ম্যানশন হল কলকাতা শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। এক্সাক্ট লোকেশনটা হলো : এসপ্ল্যানেড ম্যানশন কলকাতার কেন্দ্রস্থলে। এসপ্ল্যানেড রো (পূর্ব ) এবং মার্কস এঙ্গেলস বিথি রোড ক্রসিং-এ, রাজভবনের পূর্বদিকে এবং কার্জন পার্কের বিপরীতে।
এসপ্ল্যানেড কথাটার মানে হলো এক মস্ত বড়ো, খোলা-মেলা সমতল জায়গা, নদী বা সমুদ্রের কাছাকাছি, যেখানে মানুষ জন হাঁটতে পারে, আনন্দের জায়গা। সেই সূত্র ধরে দেখলে, গঙ্গার পারের এই জায়গাটা একদম মিলে যায়। তার সাথে বাড়িটার নামও মানানসই ।
The esplanade mansion |
যতটুকু জেনেছি এই এসপ্ল্যানেড ম্যানশন-ই হলো কলকাতা তথা ভারতের (আগের ভারত ) একমাত্র 'আর্ট নুভেউ' স্টাইলে তৈরি বাড়ি। তবে মুম্বাইতেও নাকি আর্ট নুভেউ স্টাইলে একখানা অট্টালিকা আছে। বৃত্তাকার ব্যালকনিএবং খিলানযুক্ত জানালা রয়েছে। এই বাড়িতে ২৪টি ফ্ল্যাট আছে | কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কর্তৃক গ্রেড-১ হেরিটেজ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত |
Front view of the building. |
'আর্ট নুভেউ' কথাটার অনেক তাৎপর্য আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে এই আর্ট নুভেউ স্থাপত্য শিল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল। আর্ট নুভেউ স্টাইল ঐতিহাসিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া ছিল। এটি প্রাকৃতিক ফর্ম যেমন গাছ-পালা, ফুলের পাপড়ির ভাঁজ, বক্ররেখা এইসব দিয়ে অনুপ্রাণিত শিল্প । আর্ট নুভেউ-র কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যেমন : গতিশীলতা, আন্দোলনের প্রকাশ যার জন্য এই স্টাইলের স্থাপত্য মানে পাতি কথায় বাড়ি/অট্টালিকা প্রধানতঃ অস্বাভাবিক আকারের হয় এবং তৈরি করতে বড় খোলা জায়গা দরকার। এই ধরণের বাড়ি তৈরির উপকরণ হলো, লোহা, কাচ, সিরামিক এবং আর পরে কংক্রিট এলো। বিভিন্ন ভাষায় (দেশ অনুযায়ী ) বিভিন্ন নাম আছে এই স্থাপত্য-র : জার্মান ভাষায় জুজেন্ডস্টিল, ইতালি ভাষায় স্টাইল লিবার্টি, ইংরেজিতে এটি আধুনিক স্টাইল।
Right side view, with the Raj Bhavan gate of Esplanade Row (E) |
এই স্টাইলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফাইন আর্ট আর অ্যাপ্লায়েড আর্টের মধ্যে ঐতিহ্যগত পার্থক্য ভেঙে ফেলা। যদিও এই ফর্মের আর্ট (চারুকলা, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য ) অন্যান্য জায়গায় যেমন : গ্রাফিক আর্ট, আসবাবপত্র, গ্লাস আর্ট, টেক্সটাইল, সিরামিক, গহনা এমনকি নানা ধাতুর ওপর বিস্তর দেখা যেত কিন্তু সেই আর্টকে ভিত্তি করে বাড়ি বানানো হয় নি।
কিছু ব্রিটিশ ও ফরাসি শিল্পীরা এই শিল্পের আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যা ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছিলো ইউরোপের অন্যান্য দেশ গুলোতে আর তার ফলে এই চারু শিল্পে (painting, sculpture, decorative arts) অনেক পরিবর্তন এসেছিলো। আসলে তারা সবাই চেয়েছিলেন এই নতুন ধরণের শৈল্পিক কারুকার্য সাধারণ মানুষকে উন্নত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য, আসবাবপত্র এবং শিল্পকে একটি সাধারণ শৈলীতে একীভূত করবে।
১৮৯০-এ ব্রাসেলসে প্রথম আর্ট নুভেউ স্টাইলে বাড়ি তৈরি হয় আর বাড়ির ভেতরে, আনাচে-কানাচে সব কিছুতেই এই আর্ট ফর্ম থাকতো। সিঁড়ির রেলিঙে, চেয়ারে, ওয়াল ক্যাবিনেট, ল্যাম্প, জানলার সার্সি, দরজার আর্চ-এ। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠায় ব্রাসেলস থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পরে প্যারিসে। ফলে পাবলিক প্লেস প্যারিসে মেট্রোর এন্ট্রান্স (এখনো রয়েছে) গুলোতে আর্ট নুভেউ-এর ছোঁয়া লাগলো।
তারপর একে একে, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ইউরোপের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন নাম নিয়ে। তাই এক-এক দেশে এক-এক ধরণের নাম।
আর্ট নুভেউ শব্দটি প্রথম ১৮৮০-এর দশকে বেলজিয়ান জার্নাল L'Art Moderne-তে বেরোয়। ব্রিটেনে, ফরাসি শব্দ আর্ট নুভেউ সাধারণত ব্যবহার করা হত, কিন্তু ফ্রান্সে একে কখনও কখনও "স্টাইল জুলস ভার্ন" (ঔপন্যাসিক জুলস ভার্নের নামানুসারে ) বলেও চালু ছিল।
Left side view, clicked from Raj Bhavan (Governor House) |
বাড়ির ইতিহাস : ১৯১০ সালে ইহুদি ব্যবসায়ী ডেভিড ইলিয়াস এজরা এই বাড়িটি বসবাস করার জন্য তৈরি করেছিলেন। তার তৈরি আর একটা বড়ো বাড়ি হলো চৌরঙ্গী ম্যানশন | ডেভিড ইলিয়াস এজরা কলকাতা পৌরসভার কমিশনার ছিলেন ও পরে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একজন Director ছিলেন | একসময় এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। ডেভিড ইলিয়াস এজরার জন্ম, মৃত্যু দুটোই কলকাতায়। ১৮৭১ সালে উনি জন্ম গ্রহণ করেন। ডেভিড ইলিয়াস এজরার রাচেল সাসুনকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ে বরাবর এজরা-সাসুন পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁর প্রপিতামহ জোসেফ এজরা ১৮২১ সালে বাগদাদ থেকে বোম্বে হয়ে প্রথম কলকাতায় আসেন। এজরা পরিবার বাগদাদের ইহুদি সম্প্রদায় থেকে আগত। ডেভিড জোসেফ এজরা ছিলেন একজন ব্যাপারী (বণিক), বিনিয়োগকারী এবং কলকাতা ও ভারতের বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক নেতা। ক্যানিং স্ট্রিটে মেগান ডেভিড সিনাগগ ও চিৎপুরে বেথ এল সিনাগগ এজরারাই তৈরি করে গেছে |
কলকাতা 'দি সিটি অফ জয় ' বরাবর, সবাইকে যত্নে ওয়েলকাম করে। এজরা পরিবার বাগদাদে থাকাকালীন শুনেছিলো কলকাতার উদার মনের কথা, তাই সেখানে থাকতে ইরান-ইসরায়েলের ঝামেলা এড়াতে এখানে চলে আসে
এই এজরাদের নাম বেশ মজাদার : ডেভিড ইলিয়াস এজরার বাবার নাম ইলিয়াস ডেভিড এজরার তাঁর বাবার নাম ছিল ডেভিড জোসেফ এজরা আর তার বাবার নাম ছিল জোসেফ এজরা। এই জোসেফ এজরা ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়া প্রথম ইরাকি ইহুদি পরিবার গুলির মধ্যে ছিল বলে তাদের আরবী শব্দতে জোসেফ এজরা খলিফ বা জোসেফ এজরা বাহের নামও ছিল। জোসেফ এজরা তার দুই ছেলে নিসিম এবং ডেভিড জোসেফ এজরাকে নিয়ে কলকাতা আসেন। তৎকালীন সময়ে এজরা পরিবার "অন্যতম ধনী" নামে খ্যাত ছিল। জোসেফ এজরা কিছুকাল পর বাগদাদে ফিরে যায় কলকাতায় আর আসেননি। তার বড়ো ছেলে নিসিম সিঙ্গাপুরে চলে যান যেখানে তিনি বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ছোটো ছেলে ডেভিড জোসেফ এজরা কলকাতায় পাকাপাকি থাকতে শুরু করে এবং অস্বাভাবিক দূরদর্শিতায় তিনি সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে বেছে নিয়েছিলেন কলকাতাকে , যা তখনও একটি উদীয়মান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল মাত্র এবং তখনও এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়নি।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার সবচেয়ে ধনী ইহুদি পরিবার ছিল এজরারা । মূলত নীল (ইন্ডিগো ), রেশম আর আফিম ব্যবসার কারণে তাদের সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল যা তিনি রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেছিলেন।
এসপ্ল্যানেড ম্যানশনের আগে ওই জায়গায় নাকি ছিল স্কট থম্পসনের দোকান । বাড়িটি তৈরির কন্ট্রাক্ট নিয়েছিল রাজেন মুখার্জী মহাশয়ের বিখ্যাত মার্টিন অ্যান্ড কোং । এই এজরা পরিবারের নামানুসারে 'এজরা স্ট্রিট ' রাস্তার নামকরণ হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসপ্ল্যানেড ম্যানশন প্রথমে আমেরিকান সৈন্যদের থাকার জন্য ও পরে আমেরিকান লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল।
The building mostly occupied by LIC, after restoration. |
এখন বেশিরভাগটাই জীবন বীমা কর্পোরেশনের অফিস তাছাড়া রেলওয়ে ও অন্যান্য আরো কিছু সরকারী অফিস রয়েছে এই বাড়িতে। ২০০৩ সালে, এলআইসি এসপ্ল্যানেড ম্যানশনকে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন আগের ওই হাল্কা গোলাপি রঙের পরিবর্তে এখনকার এই সাদা রং করে। মোটামুটি সারাতে ১১ লাখ টাকা খরচ হয় ।
"পরশ পাথর" (দ্য ফিলোসফার্স স্টোন) সিনেমার শুটিং চলাকালীন, সত্যজিৎ রায় এই বিল্ডিংয়ের উপর থেকে ছবিটির জন্য একটি শট নিয়েছিলেন।
Comments
Post a Comment