Skip to main content

হোটেল স্পেন্সেস বর্তমানের ট্রেজারি বিল্ডিং

 'দ্য স্টিম হাউস' নামে ফরাসি উপন্যাসিক জুলস ভার্নের লেখা একদল ট্রাভেলার দের নিয়ে একখানা উপন্যাস (ট্রাভেলব্লগ বলা ভালো ) আছে।  বইটা ১৮৮০ সালের, হাতির ছবি দেওয়া তাতে একটা ছোট খাটো বাড়ি হাতি টেনে নিয়ে চলছে।  এই বইটাতে ভারতে ব্রিটিশ জামানার সময় অনেক গুলো রাজ্যের কথা রয়েছে।  আর যেহেতু কলিকাতা তৎকালীন রাজধানী ছিল স্বাভাবিক ভাবেই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।  সেখানে লেখক লিখেছেন ''...ভোরের আগে, আমাদের শুরুর সকালে, আমি কলিকাতার সেরা হোটেল গুলির মধ্যে একটি হোটেল স্পেন্সেস-এ ছিলাম । আমার আগমনের পর থেকেই সেই হোটেল আমার বাসস্থান হয়েছিল । "  বর্তমানের এই  ট্রেজারি বিল্ডিং ছিল জুলস ভার্নের "হোটেল স্পেন্সেস " ।

রাজ ভবনের পশ্চিম দিকে দুটো গেট আছে, আকাশবাণী ভবনের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে যাবার সময় দ্বিতীয় গেটটার ঠিক উল্টো দিকে 'এসপ্ল্যানেড রো (পশ্চিম)'  রোডে টকটকে লাল রঙের একটা বিল্ডিং রয়েছে, যেটা বর্তমানে ট্রেজারি বিল্ডিং (এজি বেঙ্গল ) নামে পরিচিত সেটাই ছিল ওই উপন্যাসের "হোটেল স্পেন্সেস ", তার ঠিক পাশেই  টাউন হল ও হাইকোর্ট তারপর গঙ্গা।


রাজ ভবনের ঠিক উল্টো দিকের দেওয়ালে 


 
লাল রঙের এই বিশালাকৃতি, সুন্দর বিল্ডিংটা ১৮৩০ সালের আগে জন স্পেন্স তৈরি করেছিলেন । ই.জে. মার্টিন ছিলেন আর্কিটেক্ট আর সি.জে. মিলস ছিলেন পুরো কাজটার তত্বাবধানে। অট্টালিকাটার কাঠামো একদম ক্লাসিক্যাল ইউরোপিয়ান ধাঁচের, লাল রঙের ইট দিয়ে সমান ভাবে সমতলে চতুর্ভুজ আকৃতির।  এতে খুব সুন্দর করে খিলান (আর্চ ) সহ লম্বা-লম্বা জানালা আছে তার সাথে ম্যাচ করে অপূর্ব কারুকার্যের করিন্থিয়ান পিলার ( প্রাচীন গ্রিক ও রোমান আর্কিটেকচার ) রয়েছে। আর ওই পিলার গুলোর সাথে ছাদের সংযোগস্থলে জোড়া ফিনিক্স রয়েছে।  খুব যত্নে আর নিপুন ডিসাইন করা পুরো অট্টালিকাটায়  : ফিনিক্স গুলো স্কোয়ারের পুরো জায়গাটা জুড়ে এতো সুন্দর গ্যাপ দিয়ে বসানো যে দেখে মনেই হয়না এতো পুরোনো বিল্ডিং। এই বাড়িটায় অনেক আলংকারিক স্থাপত্য শিল্পের কাজ আছে , যেমন : খিলান প্রবেশদ্বার, বাড়ির চতুর্ভুজাকার রেলিং বরাবর  লম্বা ক্লোস্টারের প্রতিটি প্রান্তে অপূর্ব ম্যানসার্ড বসানো রয়েছে, এগুলো পুরো বাড়িটাকে এক অন্য রূপ দিয়েছে।  তারপর  ১৮৮২-১৮৮৪ সালের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের আমলে এই স্পেন্সেস হোটেলের এই বিল্ডিঙয়েই ভারতের অর্থ বিভাগের সব অফিস গুলোকে একসাথে আনা হয়েছিল । এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস-এর প্রধান কার্যালয় হলো ঐতিহাসিক ' হোটেল স্পেন্সেস' ।


তৎকালীন ও বর্তমান ঠিকানা 

 করিন্থিয়ান পিলার ও লম্বা খিলান (আর্চ) গুলো 

পিলার গুলোর সাথে ছাদের মাঝখানের জোড়া ফিনিক্স



 

মিরর ইমেজ 


 আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে, এই স্পেন্সেস হোটেল ছিল, এশিয়ার প্রথম হোটেল, যা ১৮৩০ সালে জন স্পেন্স সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন। সেই সময় কলকাতার ব্যাপারটাই অন্য রকম ছিল, ওত্তো বড়ো দেশের রাজধানী বলে কথা :  ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত বিভিন্ন  দেশের লোকেরা কলকাতা শহরে ঘন ঘন আসতেন, কারণ এটি ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা ও বাণিজ্য কেন্দ্র ( এখন নয়, তখন ) ।  সেই সময়ে কলকাতা তথা পুরো এশিয়ার সেরা হোটেল হিসেবে গণ্য হয়েছিল 'স্পেন্সেস' । ব্রিটিশ আইল এবং ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে শহরে প্রচুর সংখ্যক নিয়মিত দর্শনার্থীদের স্থান দিয়ে দ্রুত ব্যবসা করার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ' হোটেল স্পেন্সেস' ।  তাই অনেক পরিকল্পনা করে  তৈরি এই স্পেন্সেস হোটেলটি নির্মাণ করা হয়েছিল যা নিয়মিত চালু ছিল আর এতে থাকার জন্য বহু আগে 'বুকিং ' করার ব্যাবস্থা করতে হতো।  বেশ কিছু বছর পর  সময়ের সাথে সাথে, সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে, ঔপনিবেশিক তৎকালীন সরকার তার ক্রমবর্ধমান বিভাগ এবং আবাসিক কোয়ার্টারগুলির জন্য নতুন অফিস নির্মাণের জরুরী প্রয়োজন অনুভব করে । দিনের প্রয়োজন মেটাতে সরকার আক্রমনাত্মকভাবে গভর্নমেন্ট হাউসের আশেপাশের সমস্ত জমিজমা অধিগ্রহণ করতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, ১৮৮০-এর দশকে স্পেন্সেস যে জমিতে দাঁড়িয়েছিল সেটি সরকার দখল করে নেয় এবং হোটেলের জায়গাটি পরে ট্রেজারি বিল্ডিং নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করা হয়, যা ব্রিটিশ ভারতের অর্থ বিভাগের জন্য ছিল,  এখন যা এজি বেঙ্গলের আবাস।

 আর স্পেন্সেস হোটেল পরে গভর্নর হাউসের কাছে ওয়েলেসলি প্লেসে স্থানান্তরিত  হয়ে যায়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ডালহৌসি এলাকায় আসতেন সম্ভবত তারা টেলিফোন ভবনের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ডানদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি হোটেলের অবিচ্ছিন্ন বিল্ডিং লক্ষ্য করেছিলেন, যা ওয়েলেসলি প্লেস নামে পরিচিত ছিল, পরবর্তীতে তা রেড ক্রস নামে পরিচিত।   সেখান থেকেও স্পেন্সেস তার নাম ও গৌরব বজিয়ে রেখেছিলো।  জনপ্রিয়তা একই রুক্ম ছিল।  কিন্তু কেন যে এটি শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হয় তার কোনো হদিস নেই, আর কেনই বা এবং ঠিক কখন এমন চালু হোটেল বন্ধ হয়েছিল সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই।  কালের গর্ভে জাস্ট গায়েব হয়েগেছে।  এই হোটেলের একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে : মহারাজা রণজিৎ সিংহ-র ছোট ছেলে ও মহারানী জিন্দ কর-এর একমাত্র সন্তান মহারাজা দলীপ সিং ১৮৬১ সালের ১৬ই জানুয়ারী এই স্পেন্সেস হোটেলে তার মায়ের সাথে করেন এবং তার সাথে তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ( মহারানী জিন্দ কর-কে ব্রিটিশরা তাতে বন্দি করে রেখেছিলো সাথে অত্যাচারের জন্য তিনি পঙ্গু ও অন্ধ হয়ে যান, জীবনের বাকি ক'টা দিন ছেলের সাথে ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন  )

তবে মহান ফরাসি ঔপন্যাসিক জুলেস ভার্ন লেখা পরে বোঝা যায় তিনি স্পেন্সেস হোটেলটিকে কলকাতা তথা দেশের অন্যতম সেরা হোটেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।   তিনি শহরে আসার পর থেকেই তার বাসস্থান বানিয়েছিলেন। আর এটা যথেষ্ট প্রমাণ করে যে হোটেলটি সেই সময়ে ইউরোপীয়দের কাছে সুপরিচিত ছিল।  মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের (শঙ্কর) রচিত জনপ্রিয় উপন্যাস  ' চৌরঙ্গী 'ওয়েলেসলি প্লেসে অবস্থিত এই বিখ্যাত হোটেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।

ফটোগুলো :

রাজ ভবনের পশ্চিম দিকের রাস্তার পাশের দেওয়ালটাই ঠিক আছে , বাকি গুলোর অবস্থা নিচের ছবিগুলোয়।  গিয়ে দেখে আসতে পারেন, হোটেল স্পেন্সেস-র কি হাল, আজকাল। 




বর্তমানে জামা কাপড় মেলা হয় 

ওয়েলেসলি প্লেস বা রেড ক্রস-এ স্থানান্তরিত স্পেন্সেস হোটেলের কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে ঝেপে দিলাম, যা এখন আর অবশিষ্ট নেই। 


The Spence's Hotel from the Government Place (West), Photo- Fredrik Fiebig (1851). 




Comments

Popular posts from this blog

কদম ফুল - Kadam phool- common burflower

বর্ষাকালের সিগনেচার বলা হয় কদম ফুলকে , আরেক নাম নীপ , " এসো নীপ বনে ... " কবিতা তো জানাই আছে যাতে বর্ষা মানেই নীপ ( কদম্ব ও বলে অনেক রাজ্যে ) ।   খুব পরিচিত এই ফুল , নিটোল গোলাকার , প্রথমে সবুজ , পরে লাল থেকে টকটকে কমলা রঙের সাথে অসংখ্য লম্বা সাদা ফ্রিলস পুরো ফুল জুড়ে ।   হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ একটু ভারী , মানে কাউকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আর ওই সাদা ফ্রিলস গুলো এমনিতে নরম কিন্তু ছুড়লে হুঁহুঁ , লাগবে বেশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে , গাছের পাস দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় ফুল ফুটেছে   ( কদম তলায় কে ?) । প্রচুর ফ্র্যাংগনান্স বা আতর তৈরি হয় এই গন্ধের। আমাদের দেশের লিপিগুলোতে কদম ফুলের ও গাছের নাম আছে আর আমাদের পৌরাণিক কথকথায় কদম ফুলের বড়ো মুখ্য একটা জায়গা আছে।   ভারতের উত্তর দিকে , ভগবৎ পুরান থেকে শুরু রাধা ও কৃষ্ণের দুজনের জীবনেই   কদম ফুল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।   বৃন্দাবন - মথুরায় , গোবর্দ্ধন পাহাড়ের দিকে   প্রচুর কদম গাছ , এই সময় মানে বর্ষাক...

Aboriginal Art: Story Behind the Dot

First time I noticed this wonderful Dot Art at Melbourne museum and from the description get to know that this Dot Art is world famousAboriginal Art of Australia which is now internationally recognised. Then at the Victoria market got the full scope to explore the Dots of the art. The Aboriginal Art  painted in acrylic are a beautiful blend of traditional and contemporary form and the dot technique gives the painting an 3D effect and a sense of movement and rhythm too. My collections Photos from Victoria Market:  There are many shops in the market where selling several Art forms at a reasonable price and … more importantly to me a great chance to know the story behind the Dots. After taking with a shop owner he started to telling me whatever he knows about the Dot art and the artist of this artwork. This art is a team work because minimum 2 persons are needed to do the art. One will draw other person will do the Dots, finally the story of Art will emerge. So, bigger and depth ...

My days in the Gunj 2

Since couple of months planning to go in the Gunj but due to some other directions wasn't able to reach there. Finally at the end of year 2023 reached there, stayed in the colonial hut and explored the place on my motorcycle. The Gunj means the McCluskieganj, during mid nineties this hamlet was known as Mini England as it was the place for Anglo-Indians. But now only few family of Anglo-Indians are living here. Yeah, here is scope to stay in the colonial tiles hut as few of the homes are still maintaining the traditional home. I reached on 22nd of December, and had an advanced booking as this time become so crowded due to the holiday and festive season. While I was looking for my stay in Gunj as I used to do getting the contacts from google and calling them. Most of the homestay were not vacant on the dates which I decided to be there, but from the owner of Amyra homestay got a contact of Manojay the care taker Mac Garden and for 2 days he has a room. Here is a story, Mr. Raj Kisho...